By মুক্তি বার্তা
যশোর-খুলনার দুঃখ ভবদহে আবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে
নিউজ ডেস্কঃ যশোর-খুলনার দুঃখ ভবদহে আবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ অ লের অর্ধশত গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় শুধু অথৈ পানি আর পানি। জলাবদ্ধ এলাকার হাজার হাজার পানিবন্দী মানুষের এখন সীমাহীন দুর্ভোগ। এ সব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে পরিকল্পিত জোয়ার আধার প্রকল্পের দাবি আজও উপেক্ষিত রয়েছে। ভুক্তভোগী জনগণের একটিই কথা ভবদহ অ লের বিলসমূহে পর্যায়ক্রমে টিআরএম (টাইটাল রিভারস ম্যানেজমেন্ট তথা জোয়ার আধার প্রকল্প) চালুর মাধ্যমে ভবদহের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। টিআরএমকে উপেক্ষা করে নদীখনন,পলী অপসারণ,বাধঁনির্মাণসহ বিভিন্ন সময়ে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট গ্রহণ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং এসব প্রজেক্টে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ভবদহ অ লের ভুক্তভোগী জনগন ভবদহের স্থায়ী সমাধানে আবারও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করছেন। তারা পরিকল্পিতভাবে ভবদহের বিভিন্ন বিলে পর্যায়ক্রমে জোয়ার আধার প্রকল্প চালুর দাবিতে এখন ফুঁসে উঠেছেন। টিআরএম এর দাবিতে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি মানববন্ধন,বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, জোয়ারের ও বৃষ্টির পানিতে ভবদহের প্রায় ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। এ সব গ্রামের লক্ষাধিক পানিবন্দী মানুষ চরম দূর্ভোগে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অতিসম্প্রতি এক সপ্তাহের টানা ভারী বর্ষণে নতুন করে আরও কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীতে পলী জমে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভবদহ অ লে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ভবদহের বিস্তীর্ণ এলাকায় দিন পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে ভবদহ পাড়ের জনগন আরও শতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে আশস্কা করছেন।
গত শুক্রবার সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৪০ বছর ধরে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে ভবদহ অ লের মানুষ দুর্বিসহ এক সীমাহীন দুর্ভোগের কবলে পড়ে পানির সাথে লড়াই করে এক অনিশ্চিত জীবন-কাল অতিবাহিত করে আসছেন। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কাজে তা কোন সুফল বয়ে আনছে না বলে দাবি ভুক্তভোগী ভবদহ পাড়ের মানুষের। স্থানীয় ভুক্তভোগী জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ভবদহ অ লের বিল কেদারিয়া ও বিল খুঁকশিয়ায় টিআরএম চালু করে অনেকটা সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পর্যায়ক্রমে টিআরএম চালু না করায় ভুক্তভোগী জনগনের একটি অংশ এর বিরোধীতা করে আসছিলো। ফলে গত কয়েক বছর হলো বিল কপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প চালু করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত কয়েক বছর ধরে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে নদীর নাব্যতা ফিরে আনতে ও জোয়ার-ভাটার গতিধারা অব্যাহত রাখতে নদীর পলি অপসারনের খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই কাজে সরকারের গৃহীত কোটি কোটি টাকার বাজেট ব্যয় করে দৃশ্যমান কোন সুফল হচ্ছে না। বরং এই কাজে লুটপাট ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করছে ভবদহ এলাকার ভুক্তভোগী জনগন।
স্থানীয়রা জানান, ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে শ্রী, হরি ও টেকা নদীতে পলী অপসারণে খনন কাজ করা হচ্ছে। টেকা নদীতে যখন এ খননকাজ চলছে, তখন শ্রী ও হরি নদী ভরে উঠছে পলিতে। আবার টেকা নদীতে যেটুকু খনন করা হচ্ছে, সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে উঠে আসা পলি ও খননের মাটি পড়ে আবার নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘদিনের পরিক্ষীত ও গ্রহণযোগ্য প্রকল্প জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বর্তমানে ভবদহের কোন বিলে কার্যকর নেই। এ অবস্থায় ভবদহ এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীতে ব্যাপক হারে পলি জমে বিলের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ভবদহ সুইচ গেটের ২১ কপাটের (ভেন্ট) উজান ও ভাটিতে শ্রী নদীতে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। ফলে ভবদহ এলাকার বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। জানা যায়,আসাদ এন্টার প্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এক্সক্যাভেটর দিয়ে নদীর পলি অপসারন করছে। খনন করা মাটি কেটে নদীর পাড়ে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। যে পরিমাণ মাটি কাটা হচ্ছে এক জোয়ারেই পলি পড়ে তার চেয়ে বেশি নদী ভরাট হচ্ছে।
সুত্র মতে, ভবদহের বিল বোকড়, বিল কেদারিয়া, বিল খুঁকশিয়া,বিল কপালিয়া,আড়পাতার বিল, ঝিলদহের বিলসহ ভবদহের বিভিন্ন বিল বর্তমান পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ডুমুরতলা, আন্ধা, বারান্দী, দিঘলিয়া, কোটা, রাজাপুর, সুন্দলী, ভাটবিলা, সড়াডাঙ্গা, হরিশপুর, ফুলেরগাতি, দামুখালী, দত্তগাতি, জিয়াডাঙ্গা ও হাটগাছা, কুলটিয়া, সুজাতপুর, লখাইডাঙ্গা, মহিষদিয়া, আলীপুর, পোড়াডাঙ্গা, পদœানাথপুর, পাড়িয়ালী, দহাকুলা, কুচলিয়া, নেবুগাতি, পাঁচকাটিয়া, ভুলবাড়িয়া, কুমারসীমা, বালিধা, পাঁচাকড়ি, কপালিয়া, মশিয়াহাটি গ্রামসহ অন্তত ৫০টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এ সব এলাকার কোথাও আংশিক আবার কোথাও বেশীর ভাগ বাড়িতে পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভবদহ অধ্যুষিত যশোরের মণিরামপুরসহ অভয়নগর,কেশবপুর, যশোর সদর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার বহু গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিমত ধারাবাহিকভাবে ভবদহের বিল কেদারিয়া, বিল খুঁকশিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য বিলে যথাসময়ে টিআরএম বাস্তবায়ন হলে অতীতের ন্যায় আবারও ভবদহ অ লে এই ধরনের জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। নদী খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরে পায়নি বরং জোয়ারের পলিতে নদী দিন দিন ভরাট আবার ভরাট হয়ে যাওয়ায় কোন বিলের পানি ভবদহ সুইচ গেট নিয়ে নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ভারি বর্ষণে মণিরামপুর,কেশবপুর ,অভয়নগর,ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও যশোর সদর উপজেলার প্রায় দেড় শতাধিক গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে বলে এলাকার ভুক্তভোগী জনগন আশংকা করছেন। তাদের ধারনা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভবদহ অ লের হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়হীন ও কর্মহীন হয়ে পড়বে।
ভবদহ সমস্যা সম্পর্কে কথা হয় যশোর জেলা পরিষদের সদস্য ও মণিরামপুরের ভবদহ অধ্যুষিত নেহালপুর ইউনিয়নের বালিধা গ্রামের ফারুক হোসাইনের সাথে। তিনি বলেন, নদী খনন করে তেমন সুফল হচ্ছে না। তিনি নদী খনন করে পলি অপসারণের পাশাপাশি ভবদহের বিভিন্ন বিলে পর্যায়ক্রমে টিআরএম বাস্তবায়ন করলে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগী জনগনের সাথে কথা বলে জনগনের আর্থিক নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এতে এলাকার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রণজিৎ কুমার বাওয়ালি বলেন, ভবদহ সুইচগেটই অভিশাপ। সুইচগেটের কাছে শ্রী নদীতে পলি জমে ভবদহ অ লের ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভবদহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেই আশির দশক থেকে জলাবদ্ধতায় আজ যশোর-খুলনার দুঃখ হিসেবে ভবদহ এখন এলাকার মানুষের জীবন-মরন সমস্যা হিসেবে দেখো দিয়েছে। নদী শাসন বন্ধ করে প্রত্যেক বিলে পর্যায়ক্রমে পরিকল্পিতভাবে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে পারলে ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। ভবদহের অভিশাপ থেকে এলাকার মানুষ মুক্তি পাবে।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সমন্বয়ক গাজী আবদুল হামিদ জানান, সরকার প্রতি বছর পাইলট চ্যানেলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অপচয় করছে। কিন্তু আমরা জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছি না। এতে জনগনের কোন সুফল আসেনি, উল্টো সরকারী অর্থ লোপাট হয়েছে।
ভবদহ সুইচগেট (জলকপাট)রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যসহকারী ফারুক হোসেন জানান, ভারি বৃষ্টিতে পলি পড়ে ভবদহ সুইচগেটের ২১ কপাটের সবকটিই পলি পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। সে গুলোর পলি অপসারনের কাজ চলছে। এখন নদী দিয়ে প্রবল জোয়ার আসছে, কিন্তু ভাটায় কম পানি বের হচ্ছে। যার কারণে পানি নিষ্কাশন সঠিকভাবে না বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৗশলী মোঃ তাওহীদুল ইসলাম বলেন, গত বছর ১০ কিলোমিটার নদীর পাইলট চ্যানেল খনন করা হয়। খননের পর পলিতে নদী সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে। এবার শ্রী নদীর ১ হাজার ৩০০ মিটার খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তেশ্বরী নদীর ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং ভবদহ সুইচগেটের উজান ও ভাটিতে শ্রী নদীতে ২০০ মিটার করে ৪০০ মিটার খননের কাজ চলছে। তিনি জানান, ভবদহের একটি অ লের পানি আমডাঙ্গা খাল হয়ে ভৈরব নদে যায়। কিন্তু এবার ভৈরব নদে অনেক উচ্চতায় জোয়ার আসছে। এতে পানিনিষ্কাশনের পরিবর্তে ভৈরব নদ থেকে আমডাঙ্গা খাল দিয়ে উল্টো পানি ঢুকছে। এ জন্য আমডাঙ্গা খালের ওপর অবস্থিত ছয় কপাটের সুইচগেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ওই অ লে পানি জমে গেছে। জোয়ারের চাপ কমে গেলে দুই-এক দিনের মধ্যে আমডাঙ্গা খাল দিয়ে পানি নেমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সূত্র-ভোরের ডাক
মুবার্তা/এস/ই