By মুক্তি বার্তা
শান্তিপূর্ণভাবে আল্লামা শফীর শূন্যতা পূর্ণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ
নিউজ ডেস্কঃ বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) ও আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়ার প্রধান ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। আল্লামা শাহ আহমদ শফী আমৃত্য বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষা ও রাজনীতির মূলধারা শীর্ষ তিনটি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লামা শফীর শূন্যতা প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন করে পূর্ণ করবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর আগে থেকেই তিন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতৃত্বে কে আসবেন, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ছিল কিছু উত্তেজনাও। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হাটহাজারীতে। ফলে শান্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে তিন প্রতিষ্ঠানে আল্লামা শফীর উত্তরাধিকার নির্ধারণের বিষয়টিই এখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।
সন্দেহ নেই, আল্লামা শফী দীর্ঘ বছরের পরিক্রমায় ধাপে ধাপে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে এসেছিলেন। ১৯৪৬ সালে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পান তিনি।
১৬ সেপ্টেম্বর (২০২০) হাটহাজারী মাদ্রাসার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছাত্র-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে তার মহাপরিচালক পদটি চলে যায়।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি দারুল উলুম হাটহাজারী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হয়। আল্লামা আহমদ শফী প্রতিষ্ঠাতা আমির মনোনীত হন। ২০১১ সালেই তার নেতৃত্বে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরুদ্ধে’ চট্টগ্রামে কর্মসূচি পালিত হয়। তখন ঢাকায় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ইসলামী রাজনীতির জাতীয় নেতৃত্বে ছিলেন। ২০১২ সালে এই দুই নেতার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে ঢাকার আলেমদের মধ্যে নেতৃত্বহীনতা সৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় স্তরের নেতৃত্বে উত্থান ঘটে আল্লামা শফীর।
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হন কওমি আলেম সমাজ। হাটহাজারী মাদ্রাসায় সারাদেশের সিনিয়র আলেমদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আল্লামা আহমদ শফী ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে ‘লং মার্চ কর্মসূচি’র ডাক দিয়ে আলোচিত হন। ‘নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি এবং ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসহ ব্লাসফেমি আইন করার দাবিতে’ অনুষ্ঠিত লংমার্চ শাপলা চত্বরে এসে বিশাল জমায়েতে মিলিত হলে প্রথমবারের মতো দেশে-বিদেশে মনোযোগ আকর্ষণ করে আল্লামা শফী ও হেফাজতে ইসলাম । মতিঝিলের সমাবেশ থেকে হরতাল কর্মসূচির পাশাপাশি এক মাসের আল্টিমেটাম দিয়ে বিশাল অনুসারীদের নিয়ে ঢাকা ছাড়েন তিনি।
যথারীতি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আবারও বিশাল সমাবেশ করে সেখানেই অবস্থান নেন আল্লামা শফী। দেশে সৃষ্টি হয় চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা। বিএনপি, জামায়াতের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতার কথাও তখন আলোচিত হয়। ঢাকার মতিঝিল-পল্টন-মালিবাগ এলাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ঘটে সেদিন রাতে সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর অবস্থান ও ব্যবস্থা গ্রহণের পর নিহত হন বেশ কয়েকজন হেফাজত কর্মী। আহত হন অসংখ্য কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
পরদিন লালবাগের জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থানরত আহমদ শফীকে সপুত্র চট্টগ্রামে ফেরত ও হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর থেকে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে আল্লামা শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম। বরং দেখা যায় আল্লামা শফীর সঙ্গে মহাসচিব আল্লামা বাবুনগরীর টানাপোড়েন।
এরই মাঝে অনেকবার অসুস্থ হন আল্লামা শফী। দফায়-দফায় তাকে চট্টগ্রামে ও ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তথাপি হেফাজত নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব চাপা থাকেনি। ২০২০ সালের জুনে হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় সহকারি পরিচালকের পদ থেকে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। যারই ধারাবাহিকতায় মধ্য-সেপ্টেম্বরে বিক্ষোভে উত্তাল হয় হাটহাজারী মাদ্রাসা।
তৃতীয় যে সংস্থার শীর্ষের আসেন আল্লামা শফী তার নাম বেফাক বা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি মাওলানা নুরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরীর ইন্তেকালের পর একই বছর বেফাকের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আহমদ শফী। তখন থেকে আমৃত্যু তিনি বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের সভাপতি হিসেবে ২০১৭ সালে সরকারি স্বীকৃত আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সেক্ষেত্রে বেফাকের সভাপতি যিনি হবেন, তিনিই হাইয়াতুল উলয়ার চেয়ারম্যান।
আল্লামা শফীর নেতৃত্বের আরেক কৃতিত্ব হলো মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারি স্বীকৃতি আদায়। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উল্লেখযোগ্য আলেমদের উপস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার ঘোষণা দেন। স্বীকৃতি প্রদানের কারণে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেশের আলেম ও কওমি শিক্ষার্থীদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয় আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া। বর্তমানে ৬টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সব ক’টি দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদরাসা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়ার অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
আল্লামা শফীর মৃত্যুর আগে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করে যেতে পারেন নি। সর্বত্রই একাধিক আগ্রহী ও উৎসাহী ব্যক্তি পদগুলো পাওয়ার প্রত্যাশায় কাজ করছেন। ফলে সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে শূন্যতা পূর্ণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রূপে দেখা দিয়েছে।
মুবার্তা/এস/ই