By মুক্তি বার্তা
যশোরে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের ইতিহাস….
সাজেদ রহমানঃ যশোরে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের ইতিহাস…. গ্রেগরি হারকানটস কে? কী তার পরিচয়? বা মেরি এডিলেড? সত্যি সত্যিই এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আজ কেউ নেই। তাই আজ থেকে অনেক গ্রেগরি হারকানটসের পরিচয় নিঃশেষ। সে কার সন্তান ছিলেন, কার স্ত্রী বা স্বামী, কোথায় জন্ম, কে কোন সমাধিতে শুয়ে এ সবকিছু জানার উপায় নেই। শহরের এক প্রান্তে পুরনো পাচিলঘেরা অসংখ্য সমাধি। কোনোটা ধসে পড়ছে। ইট খুলে নেয়া হয়েছে। তবে বোঝা যায় এখানে যারা শুয়ে আছেন, তাদের কোনো উত্তরপুরুষ নেই অন্তত এ শহরে। তাই নিতান্ত অবহেলা-অনাদরে সমাধিগুলো মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে।
যশোর শহরের কারবালা এলাকার খ্রিস্টান সমাধিস্থলে গেলে বারবার ওপরের প্রশ্নগুলোই মনে হওয়া স্বাভাবিক। এক সময় কবরের গায়ে পাথরে লেখা ছিল মৃত ব্যক্তির নাম। সাদা চামড়ার সাহেবরা প্রায়ই আসতেন তাদের আত্মীয়স্বজনের কবর দেখতে। কবরস্থান তত্ত্বাবধানের জন্য লোকও ছিল। এখন দেখাশোনা করে চার্চ অব বাংলাদেশ। তবে তা নিতান্ত অবহেলায়।
ধারণা করা হয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই কারবালা কবরস্থানটি ব্যবহার করছে মুসলমান সম্প্রদায়। আর এ দীঘিরই উত্তর পাশে খ্রিস্টানদের কবরস্থান। কিন্তু এর সঠিক বয়স জানাও কঠিন। যশোরে ইংরেজরা পাকাপোক্তভাবে আসে ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর। আর এরও ২৫ বছর পর ১৭৮১ সালে যশোরে স্থাপন করা হয় অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা যশোর। যশোরে প্রথম জেলা কালেক্টর হয়ে আসেন মিঃ টিলম্যান হেংকেল। তার সঙ্গে বহু ইংরেজ কর্মচারী আসেন যশোর শহরে। সম্ভবত এরপর কারবালা খ্রিস্টান কবরস্থানটি পরিণত হয় তাদের প্রধান সমাধিক্ষেত্রে।
প্রশাসনিক কাজে ইংরেজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন যশোর শহরে আসেন; তেমনই বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সবাই ছিলেন ইংরেজ। ১৭৮১ সালে মিঃ টিলম্যান হেংকেল যে পদ অর্থাৎ কালেক্টর পদে যোগদান করেন, পরবর্তীকালে সে পদটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটে পরিণত হয়। ১৯৩১ সালে এ জেলায় সর্বশেষ ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিঃ এ এস লারকিন। যশোরের প্রথম জেলা ও দায়রা জজ মিঃ পার ১৭৯৩ সালে কাজে যোগদান করেন। সর্বশেষ ইংরেজ জেলা ও দায়রা জজ মিঃ কেপি পিপলাই দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। যশোর জেলা স্কুল স্থাপিত হয় ১৮৩৮ সালে। এখানেও প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে ইংরেজ। নাম সিজে স্মিথ।
১৮৬৫ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ইংরেজদের প্রাধান্য ছিল। পৌরসভার চেয়ারম্যানের পদটির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাই এটা স্পষ্ট যে, যশোর নতুন জেলা স্থাপনের পর প্রচুর ইংরেজ কর্মচারীর কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। যশোর জেলাতে উৎপাদিত হতো নীল। নীলচাষে যুক্ত হয়ে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর ইংরেজ আসে। নীলকুঠি জেলার যে প্রান্তেই অবস্থিত হোক না কেন, যশোর শহরে তাদের অস্থায়ী আবাস ছিল।
ইংরেজ কর্মচারীদের পরিবারবর্গও যশোরে থাকতেন। তৎকালীন বইপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কলেরা মৌসুমে ওই রোগের ভয়ে ইংরেজ কর্মচারীরা তাদের পরিবারের অনেক সদস্যকে কলকাতায় রেখে আসতেন। বর্ষা মৌসুম শেষে সাধারণত এ এলাকায় মহামারী আকারে কলেরা রোগ বিস্তর লাভ করত। তবুও অনেকে মৃত্যুর ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতেন না। মারা যেতেন তারা। আর কবর দেয়া হতো কারবালা সমাধিস্থলে। সমাধিফলক অধিকাংশই ছিল পাথরের। কলকাতা ছাড়াও লন্ডন থেকে সমাধিফলক তৈরি করে আনা হতো। এতে মৃত ব্যক্তির নাম, বংশ পরিচয়, পেশা, পদমর্যাদা, মৃত্যু তারিখ ও জন্ম তারিখ লেখা থাকত। যে কোম্পানি সমাধিফলক তৈরি করেছে, লেখা থাকত তার নামও।
ঊনবিংশ শতাব্দীর যশোর ও যশোর শহর ভ্রমণ করে ভোলানাথ চন্দ্র নামক এক ব্যক্তি একটি ভ্রমণ কাহিনী লেখেন। তিনি কারবালা খ্রিস্টান কবরস্থানও পরিদর্শন করেন। এ জারনি টু যশোর ইন ১৮৪৬ ইন বেঙ্গল পাস্ট এ্যান্ড প্রেজেন্ট গ্রন্থে কবরস্থানের বর্ণনা আছে। এ গ্রন্থে দেখা যায়, কবরস্থানে শায়িত আছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের মধ্যে গ্রেগরি হারকানটস-এর মতো ডেপুটি কালেক্টর, তেমনই আছেন ডেপুটি কালেক্টর এ আই স্মিথের স্ত্রী মেরি এডিলেডও। আছেন এ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন রবার্ট ব্রান্স বি ফ্রান্সিস এবং বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তা। গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৮২৮ সাল থেকে ১৮৪৬ সালের মধ্যে মারা গেছেন এসব ইংরেজ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
যারা মারা গেছেন, তাদের বয়স বিশের কোঠা থেকে চল্লিশের কোঠায়। তাই বলা হয়, তাদের সবার মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে, কলেরা, ম্যালেরিয়া বা অন্যান্য রোগে। যারা কর্মকর্তা, তাদের নামের শিলালিপি ছিল, অনেকের নাম আছে ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজে, কিন্তু যারা সাধারণ কর্মচারী তাদের কোনো নাম নিশানা নেই।
মুবার্তা/এস/ই