আজঃ শুক্রবার ● ২৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ● ১৩ই ডিসেম্বর ২০২৪ ● ৯ই জমাদিউস-সানি ১৪৪৬ ● রাত ১২:০৩
শিরোনাম

By মুক্তি বার্তা

মাস্টারমাইন্ড কী এবং কেন?

ফাইল ছবি

সোহেল সানি: চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিন্নিকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়। সে কারণে মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে  ‘মাস্টারমাইন্ড’ কথাটা হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য  ওয়ার্ল্ড।”
কেননা এমন একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের রায়ের জন্য দেশবাসীর ন্যায় প্রবাসীরাও অধীর ছিলো। রায় ঘোষণার পরপরই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে ফেইসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক গণমাধ্যমে।
রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয় সর্বমহল থেকে। বিশেষ করে এতো অল্পসময়ের মধ্যে রিফাত হত্যা মামলার রায়দানের ঘটনা বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থাও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের রায় সম্পর্কে আগাম কিছু কথাবার্তা এবং তার সঙ্গে মাননীয় বিচারকের রায়ের বা পর্যবেক্ষণের তথ্য-উপাত্তে মিল খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। মাননীয় বিচারক পর্যবেক্ষণে এমন উক্তি করেননি বলে মিডিয়াতেও হৈচৈ পড়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষ স্বীকার করেছে রায়ের অনুলিপিতেও এরকম পর্যবেক্ষণমূলক মন্তব্য নেই। মিন্নির আইনজীবী উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলেছেন। একই কথা বলেছেন মিন্নির বাবাও। যাহোক এখন অপেক্ষার পালা।
শিরোনামের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। ‘মাস্টারমাইন্ড’ আসলে কী? অতি সাধারণের তা বোধগম্য হবার কথা নয়। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোথাও মাস্টারমাইন্ড শব্দটার ব্যবহার হয়নি। মাস্টারমাইন্ডের ধারণার আবিষ্কারক নেপোলিয়ন ও এন্ডু কার্নেগী। যদিও তারা এ তত্ত্বের আবিষ্কার করেন গঠনমূলক ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য কিন্তু এর ব্যবহার হচ্ছে নানা অপকর্মে, হত্যাযজ্ঞে ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে।
মূলত, নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অসংখ্য মনের মহামিলনকে মাস্টারমাইন্ড বলা হয়।  আরেকটু খোলসা করে বললে, দুই বা ততোধিক মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে একসঙ্গে মিলেমিশে এগিয়ে যায়, তাকেই মাস্টারমাইন্ড বলা হয়।
অর্থাৎ মাস্টারমাইন্ড বলতে আসলে একদল মানুষকে বোঝায়, যাদের মাঝে থাকে মনের ও উদ্দেশ্যের মিল।
প্রকৃতি এক-এক মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছে এক-এক রকম। মানুষের মনকে ইলেক্ট্রিক ব্যাটারির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একটা ব্যাটারির তুলনায় দুটি ব্যাটারির শক্তি স্বাভাবিকভাবেই বেশী। যে টর্চলাইটে চারটা ব্যাটারি লাগে, সে টর্চলাইট তো তিনটা ব্যাটারিতে জ্বলবে না। এক-এক মানুষের মনের ক্ষমতাও এক-এক রকম। একদল মানুষের মন যদি একসঙ্গে হয়ে কোনো নির্দিষ্ট কাজে নামে, তাহলে সে কাজটা অনেক সহজে সম্পন্ন হয়ে যায়। অথচ ওই নির্দিষ্ট কাজ একজন মানুষের পক্ষে করা একেবারেই অসম্ভব। এ সমস্যা থেকেই মাস্টারমাইন্ড ধারণার জন্ম হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে মাস্টারমাইন্ডের রয়েছে সীমাহীন ক্ষমতা।
মাস্টারমাইন্ড তৈরি করার আগে নিজের মনের ক্ষমতাকে সুসংগঠিত করতে হয়। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সর্বাগ্রে। তা না হলে অন্যের মন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। মাস্টারমাইন্ড তৈরি হয় এভাবে,একজন ব্যক্তি একদল মানুষের একটা তালিকা তৈরি করলো, যাদের সে মাস্টারমাইন্ডে রাখতে চায়। এবার করলো যোগ্যতরদের তালিকা। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কার কার ওপর নির্ভর করা যায়, আনুগত্যপ্রবণ কতটুকু, কার কি বিশেষ ক্ষমতা আছে যা কাজে লাগবে, সর্বোপরি বিশ্বাসের মূল্য রক্ষা করবে কিনা, যদি এসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে তালিকাভুক্তদের মধ্য থেকে মাস্টারমাইন্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  কারো মাঝে কোনো অবহেলা বা খুঁত ধরা পড়লে তাকে মাস্টারমাইন্ড থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।
লক্ষ্য অর্জন বা হাসিলের আগে এবং পরে মাস্টারমাইন্ড সদস্যদের মাঝে উৎফুল্লভাব জিইয়ে রাখতে হয়। সবার প্রতি সবার সহমর্মিতা থাকতে হয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সময় ও দিন ঠিক করে সদস্যদের কাজটা বুঝিয়ে দিতে হয়।
লাভ হলে সবাইকে মূল্যায়ন করতে হয়। নিজের সাফল্য সবার সঙ্গে ভাগ করতে পিছপা হলে সংকট অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। নেতৃত্ব  কালও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যেমন চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যায় কে মাস্টারমাইন্ড পরিকল্পনার প্রধান কে আর কে না, সেটার চেয়েও বড় বিষয় হলো এই হত্যাকান্ডটি একটি নিঃসন্দেহে মাস্টারমাইন্ড। নয়ন বন্ড পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে নিহত না হলে আরও অজানা সত্য হয়তো বেরিয়ে আসতো। যেহেতু বলা হয়, নয়ন বন্ডের পরিকল্পনাতেই রিফাত হত্যা সংঘটিত হয়েছে। তাহলে নয়ন বন্ডই মাস্টারমাইন্ড কিনা সেটা পরিস্কার হতো। যাহোক, নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ছয় জনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছিল পর্যবেক্ষণে মিন্নিকে এই হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়েছে। যা গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই এনিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ের গড়মিলকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলছেন পর্যবেক্ষকরা।
জানাযায়, ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বক্তব্যটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। নড়েচড়ে বসেছে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নির আইনজীবীও। মিন্নি রায় ঘোষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশেই তার বাবার কাছে নির্দিষ্ট কতগুলো শর্তে জামিনে ছিলেন।
মিন্নির বাবাও রায় অসন্তোষ প্রকাশ করে ন্যায় বিচারেরর জন্য  উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলছেন। শুরুতেই সিফাত হত্যা মামলাটির প্রধান সাক্ষী এবং প্রত্যক্ষদর্শী মিন্নিকে  নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের সূত্রপাত ঘটে। ভিডিও ফুটেজও মামলার গতিপ্রকৃতিতে বিরাট প্রভাব রাখে। নয়ন বন্ড পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। মিন্নিকে সাক্ষীর স্থলে করা হয় আসামি। তাই জনমনে ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার পর সেই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার অবসানও ঘটেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য এবং মাননীয় বিচারকের অনুচ্চারিত  মাস্টারমাইন্ড শব্দটির ব্যবহার ও প্রচারে আবারও জনমনে মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার জন্ম দিলো।
বিচার প্রার্থীকে উচ্চ আদালতের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। একইভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে জনগণকে উচ্চ আদালতের রায়ের জন্য। যদিও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মুবার্তা/এস/ই

ফেসবুকে লাইক দিন