আজঃ মঙ্গলবার ● ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ● ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ● ২৯শে জমাদিউল-আউয়াল ১৪৪৬ ● রাত ২:২০
শিরোনাম

By মুক্তি বার্তা

পাকিস্তানের চোখে ‘শেরে-শহীদ-শেখ’ ছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী 

ফাইল ছবি

সোহেল সানিঃ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য ভুমিকা রাখলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা দেশদ্রোহী ও ভারতীয় দালাল বলতো বাঙালী তিন নেতাকে। শেরেবাংলা,
সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু তাদের চক্ষুসুলে পরিণত হয়েছিলেন।
অথচ আপাময় মানুষের  ভালবাসায় এ কে ফজলুল হক হলেন শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র, আর শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা তাঁদের বললেন দেশদ্রোহী,পাকিস্তানের শত্রু, ভারতের দালাল এমনকি দুষ্কৃতীকারী।
১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা পশ্চিমবঙ্গ সফরে গেলেন। কলকাতায় ব্যাপক সম্বর্ধনা দেয়া হলো শেরেবাংলাকে। এই কোলকাতার মেয়র ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালে বৃটিশ ভারত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হওয়াটা ছিল কোন ভারতবর্ষে কোন মুসলিম লীগারের জন্য একমাত্র অর্জন। অবিভক্ত বাংলার  প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই ১৯৪০ সালে  শেরেবাংলা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে বৃটিশশাসিত ভারতীয় রাজনীতির গতিধারাকে পাল্টে দেন। ভারতের দুই কোনে দুটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা। রহমত আলী বা স্যার ইকবালের “পাকিস্তান” প্রশ্ন তখনও উঠে আসেনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করে ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। একে ফজলুল হক ছিলেন অল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি।
অচিরেই সেই পদে অধিষ্ঠিত হন জিন্নাহ। অবিভক্ত বাংলার দুই বারের প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবার পর সোহরাওয়ার্দী- হাশিমের সাথে হাত মিলিয়ে চেষ্টা করেছিলেন অন্তত রাজধানী কলকাতাকে পূর্ববঙ্গের ভাগে ফেলতে। মুসলিম লীগের চক্রান্তে সোহরাওয়ার্দীর স্থলে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদটি অবাঙালী খাজা নাজিমুদ্দিন লাভ করায় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। অথচ ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দিল্লি কনভেনশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীই “পাকিস্তান প্রস্তাব” উত্থাপন করেন। শেরেবাংলার লাহোর প্রস্তাবের চক্রান্তমূলক সংশোধন করে দুটি বা একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের বদলে ভারত ভেঙে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব পাস করা হয়।
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চের নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী, সোহরাওয়ার্দী ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যতবানী অনুযায়ী ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসনই লাভ করে। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্বপাকিস্তানের আইন পরিষদে ১৪৩টি আসন পেলেও সোহরাওয়ার্দীর ওয়াদা অনুযায়ী কৃষক শ্রমিক পার্টি মাত্র ৪০টি আসন পেলেও শেরেবাংলাকেই পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। এরপরপরই শেরেবাংলা পশ্চিমবঙ্গে গমন করেন।
কোলকাতায় তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের  মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ব্যাপক সম্বর্ধনা জানান। অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা বিমোহিত হয়ে সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,”দুই বাংলার মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর, তা যেন আমি জীবনের এ শেষলগ্নে ভেঙ্গে দিতে পারি। সেই দোয়া করুন। একটি দেশের রাজনৈতিক বিভাগে আমি বিশ্বাস করি না। যারা আমাদের এই সোনার দেশকে দুইভাগ করেছে। তারা দেশের দুশমন।” মুখ্যমন্ত্রী পূর্ববঙ্গ আসার আগেই শুরু হয় তোলপাড়। পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী শেরেবাংলাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ভারতের দালাল বলে অভিহিত করেন। শুরু হয় আদমজী চক্রান্ত। মুখ্যমন্ত্রীত্ব চলে যায় শেরেবাংলা। ফলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে।
১৯৫৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মানসপুত্র সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন,”আদতে ভারত বিভাগের প্রয়োজনে আমাদের যুক্তিকে জোরদার করতেই আমরা দাবী করেছিলাম আমরা একজাতি, বাদবাকি অন্যরা আলাদা জাতি, এটা ছিল পুরোপুরি অযৌক্তিক।” ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে থেকেই এসব কথা বলেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী। এ বক্তব্যেও হৈচৈ পড়ে যায়। পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রবর্তক সোহরাওয়ার্দীর সদস্য পদ কেড়ে নেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের অধিবেশনেই।
একটি বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক আখ্যা দিয়ে। সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন,পাকিস্তান-ভারত কায়েমের পর আর দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রয়োজন হয়না। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন করে “জাতীয়তাবাদী মুসলিম লীগ” নামকরণের দাবি জানান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে অভিযুক্ত করে বলেন, ভারতের লেলানো কুকুর। আসতে চাইলে পূর্বপাকিস্তানও তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুক্তি পাবার পর বঙ্গবন্ধু বলেন ,”এতদিন ওরা আমাদের সব নিয়েছে, কিন্তু বাংলার মাটি তো নিতে পারে নাই ! মাটিই যে আমার সোনা,একে রক্ষা করলেই সব হবে।” শেরেবাংলা যেদিন বলেছিলেন, সেদিন তার পাশে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সোহরাওয়ার্দী যখন বলেন তখনও পাশে ছিলেন শেরেবাংলা ও শেখ মুজিব। কিন্তু শেখ মুজিব যখন জাতির পিতার ভাষণে রেসকোর্স ময়দানে দাড়িয়ে বজ্রকন্ঠে বলে ওঠেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তখন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ছিলেন না। শেরেবাংলা পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কলকাতা সফরে গিয়ে প্রকাশ্যে আরও বলেছিলেন,”
পাকিস্তান-এই শব্দটি বিভ্রান্ত সূচনা করবার ও স্বার্থসিদ্ধির একটি পন্থা মাত্র । কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় শিরোনাম হন “উভয় বঙ্গের মধ্যে মিথ্যার প্রাচীর ভাঙ্গিযা ফেলার সঙ্কল্প ব্যক্ত করে। তিনি বলেন দুই বাংলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে তা একটা স্বপ্ন ও ধোঁকা মাত্র।
পাদটীকাঃ স্বাধীনতা অর্জনের পর আওয়ামী লীগকে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিপক্ষের চোখ ‘ভারতীয় দালাল! লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মুবার্তা/এস/ই

ফেসবুকে লাইক দিন