By মুক্তি বার্তা
চৌগাছায় সার কেলেঙ্করির মূলহোতা নাশকতা মামলার আসামী
নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোরঃ যশোরের চৌগাছায় সার কেলেঙ্কারির মূল হোতা বলে অভিযোগ উঠেছে ডজনেরও অধিক নাশকতা মামলার আসামী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির ১নং যুগ্ম আহবায়ক সিংহঝুলি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এবং উপজেলা ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইউনূচ আলী ও ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের আরেক নেতা চৌগাছা পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আহবায়ক কমিটির ১নং যুগ্ম আহবায়ক ও চৌগাছা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হালিম চঞ্চলের বিরুদ্ধে।
সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩টি নাশকতার মামলা রয়েছে এই বিএনপি নেতা ইউনূচ আলীর বিরুদ্ধে। একইভাবে আব্দুল হালিম চঞ্চলের বিরুদ্ধে রয়েছে ৭টি নাশকতার অভিযোগে মামলা। এই দুই বিএনপির নেতার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বেই ২০১৩ সালে চৌগাছায় বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে তান্ডব চালানো হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী মাসুদ চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বিসিআইসি সার ডিলার হওয়া সত্বেও কিভাবে উপজেলা বিএনপির শীর্ষ এ নেতা ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেছেন সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে এই বিএনপি নেতাদের নেতৃত্বে চৌগাছায় সারের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন বিসিআইসি ও বিএডিসি সার ডিলাররা। আর তাদের এই কাজে বাধা দেয়ায় এবং অপরাধী সার ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় উপজেলা কৃষি অফিসার রইচ উদ্দিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট কিছু অভিযোগ তৈরি করে এই বিএনপি নেতার স্বাক্ষরে কৃষি বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকতাদের কাছে পাঠিয়েছে তারা।
জানা গেছে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ টাকা কেজি দরে চৌগাছায় টিএসপিসহ বিভিন্ন সার বিক্রি হওয়ায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। এর সূত্রধরে উপজেলা কৃষি অফিস সার ডিলারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে থাকে। কৃষি অফিসের কঠোর পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উপজেলা ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আহবায়ক কমিটির ১নং যুগ্ম আহবায়ক ১৩টি নাশকতাসহ সরকার বিরোধী নানা কর্মকান্ডের মামলার আসামী ইউনূচ আলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ‘জামায়াত’ করেন দাবি করে তার বদলির দাবিতে কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরে একটি দরখাস্ত করেছেন।
এর পাল্টা উপজেলার ২৪ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লিখিতভাবে ডিলারদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন ‘ডিলাররা সার বিক্রির কোন বিধি মানছেন না। অনেক ডিলার কোথায় সার বিক্রি করছেন তার কোন হিসেব নেই। অনেকেরই গুদাম পর্যন্ত নেই। যা আছে তাতে বরাদ্দকৃত সার পুরোপুরি রাখা যায় না। গত ২০ আগস্ট চৌগাছা শহরের মেসার্স শয়ন ট্রেডার্স নামে একজন বিসিআইসি সার ডিলার ১৭ মেট্রিকটন ডিএপি সার উত্তোলনের আগমনী বার্তা দিলেও ওই ডিলারের গুদামে গিয়ে কোন সার দেখা যায়নি। তখন উত্তোলিত সার বাইরে বিক্রি করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরপর উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম. এনামুল হক এবং সদস্য সচিব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম রইচ উদ্দিন শয়ন ট্রেডার্সকে সার বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর বেশি মূলে সার বিক্রি করা, মূল্য তালিকা না টাঙানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম দেখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম. এনামুল হক ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে মেসার্স শয়ন ট্রেডার্সকে ছয় হাজার, মেসার্স রুবেল এন্টার প্রাইজকে তিন হাজার এবং মেসার সেন এন্টার প্রাইজকে চার হাজার টাকা জরিমানা করেন। এতেই আরো ক্ষেপে গিয়ে বিএনপি নেতা ইউনূচ আলীর নেতৃত্বে সার ডিলাররা উপজেলা কৃষি অফিসার রইচ উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে উপজেলার ১৬ জন বিসিআইসি সার ডিলারসহ বিএডিসির ডিলারদের সাথে মিটিং করে উপজেলা সার বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এম.এনামুল হক এবং সদস্য সচিব ও উপজেলা কৃষি অফিসার এম রইচ উদ্দিন সাফ জানিয়ে দেন তাদের অধিকাংশেরই বরাবদ্দকৃত সার উত্তোলন করে রাখার কোন গুদাম নেই। ডিলারদের জানিয়ে দেয়া হয় এই গুদাম না থাকা চলবে না। অবশ্যই সব ডিলারদের স্থায়ী গুদাম এবং বিক্রয় কেন্দ্র থাকতে হবে। এই নির্দেশে গুদাম না থাকা ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইউনূচ আলী ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি বিএনপির আরেক নেতা আব্দুল হালিম চঞ্চলের সহযোগিতায় অন্য বিএনপিপন্থী ডিলারদের নিয়ে কৃষি অফিসারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। একই সাথে তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একজন সৎ অফিসার। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে নানা আজগুবি, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সরবরাহ করে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন এবং তার বদলি চাচ্ছেন। এই বিএনপি নেতা ইউনূচ আলী ও আব্দুল হালিম চঞ্চলসহ আরো কয়েকজন বিএনপি নেতা (সার ডিলার) পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরই কৃষি অফিসে গিয়ে ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ করেন। তারা কৃষি কর্মকর্তাদের বলেন সাংবাদিকরা অফিসে এসেছে আপনারা আমাদের জানাননি কেন? আমরা সাংবাদিকদের দেখতাম।
এসব বিষয়ে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাপস কুমার ঘোষ বলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একজন সৎ মানুষ। তিনি কৃষকের স্বার্থ দেখার কারণে ডিলারদের স্বার্থ বিঘিœত হচ্ছে। এ কারণে তারা ক্ষেপেছেন। তিনি বলেন বর্তমানে ‘জামায়াত’ শব্দটি একটি বড় অস্ত্র। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শায়েস্তা করতে কথায় কথায় ‘জামায়ত’ বানানো হচ্ছে। যেটি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। তিনি বলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কখনো কাজে ফাঁকি দেন না। বেশিরভাগ দিন সন্ধ্যার পর তিনি অফিস করেন। অথচ ডিলাররা বলছেন তিনি নাকি ঝিনাইদহে থাকেন।
ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ-ডিকেআইবি চৌগাছা উপজেলা শাখার সভাপতি মোন্তাজ আলী বলেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে থেকে সার বিক্রি পর্যবেক্ষণ করেন। বেশিরভাগ ডিলারের গুদাম যেভাবে থাকার কথা সেভাবে নেই। আবার অনেকেই মিলগেটে সার বিক্রি করে দেন। এসব কথা বললেই ‘রক্ষে’ নেই। তখন ডিলাররা কর্মকর্তাদের নানা ধরনের ত্রুটি খুঁজতে থাকেন। যখন কিছুই পান না তখন ‘জামায়াত’ করেন বলে হাস্যকর অভিযোগ করা হয়।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে আরো জানা গেছে রইচ উদ্দিনের আগে যিনি কৃষি অফিসার ছিলেন তিনি চৌগাছার এই সার সিন্ডিকেটের অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ায় তাকেও ‘জামায়াত’ তকমা দিয়ে বদলী করায় ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম রইচ উদ্দিন বলেন, সরকার কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে বদ্ধপরিকর। সে কারনে ভূর্তকি মূল্যে সার দিচ্ছেন। সেই সার যদি কৃষকের কাছে না যায় সেটি দুঃখজনক। যারা সরকারি চাকরি করেন তারা আজ এখানে কাল ওখানে থাকবেন এটিই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রেও সেটিই হবে। তাই বলে আমাকে চাপ দিয়ে ডিলাররা অনৈতিক সুবিধা নেবেন আর কৃষক বঞ্চিত হবে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। ডিলাররা ঠিকমত সার না তুললে বাজারে সার সংকট তৈরি হবে। তখন ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে সরকারের। এমন অবস্থা তৈরি হলে কৃষি বিভাগ বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হবে। আমরা চাই ডিলাররা তাদের দায়িত্ব স্বচ্ছতার সাথে পালন করুন। অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন প্রত্যেক বিসিআইসি ডিলারের ৫০ মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন গুদাম থাকার কথা। আমাদের এখানকার অধিকাংশেরই তা নেই।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজারি অ্যাসোসিয়েশনের চৌগাছা উপজেলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির ১নং যুগ্ম আহবায়ক ইউনূচ আলী বলেন উপজেলা কৃষি অফিসার একজন সৎ মানুষ। তিন বছর এখানে আছেন কোন ঝামেলা হয়নি। একমাস ধরে ঝামেলা হচ্ছে। তিন বছর হয়ে যাওয়ায় আমরা তার বদলি চাচ্ছি।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক পার্থ প্রতীম সাহা বলেন, ডিলারদের কাছ থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমাদের নয়, জেলার। কমবেশি খোঁজ নিয়ে কৃষি অফিসারের তেমন কোন দোষ পাইনি। তবুও যশোরের উপ-পরিচালককে বিষয়টি দেখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। আমি ডিডিকে বলেছি ডিসি সাহেবের সাথে কথা বলতে, ইউএনও সাহেবের সাথে কথা বলতে। তারা তো বললেই হবে না। সত্যতা তো থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন ইউএনও সার বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি। জেলায় ডিসি সাহেব সভাপতি। ডিলারদের নির্দেশনা দেয়ার সকল ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন তারা কিছু অভিযোগ করেছেন। আমার প্রশ্ন তার (কৃষি কর্মকর্তার) বিরুদ্ধে লিখলো, ইউএনওর বিরুদ্ধে লিখলো না কেন? সে তো সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছে, আইন তুলে ধরেছে। অন্যায় যদি করত, তাহলে আমার প্রশ্ন ছিল। যদি তার কোন অনিয়ম থাকে সেটাও তুলে ধরবে সংবাদমাধ্যম বা আপনারা সেটা আমি ওয়েল এক্সেভ করবো। কিন্ত কৃষকদের কল্যাণে যেটা করা উচিৎ সেটা যদি ব্যতয় ঘটে, সারের দাম বেশি রাখে বা নিয়ম মেনে না চলে। তাহলে এত পরিশ্রম করে সে যে এই পর্যায়ে এনেছে। তাদের (ডিলারদের) সেবাটা কি হলো?
তবে একান্ত আলাপচারিতায় একজন বিসিআইসি সার ডিলার নেতা বলেন উপজেলা কৃষি অফিসার সৎ মানুষ। তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন কেন প্রশ্নে তিনি বলেন কৃষি অফিসার আমাদের উপর প্রেসার করছেন। তিনি আরো বলেন উপজেলা কৃষি অফিসার আমাদের ডেকে এগুলো বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইউএনওকে (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) মিটিংয়ে নিয়ে এসে আমাদের প্রেসার করছেন। ইউএনও তো সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি, তিনি তো মিটিংয়ে থাকবেনই বললে তিনি বলেন এতদিন তো থাকেন নি। আপনি নিজে বলছেন কৃষি অফিসার সৎ আবার নিজেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছেন এটা কেমন হলো না প্রশ্নে তিনি বলেন অন্য উপজেলার সার ডিলাররা সার উত্তোলন না করেই মাসে ৮০/৮৫ হাজার টাকা লাভ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ইনভেস্ট করেও মাস শেষে ২৫ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে।’ আপনারা তো বিসিআইসির বরাদ্দ সার চিটাগাং থেকে আনেনই না, সেটি ওখানে কতটাকা লাভে বিক্রি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন ২শ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা বেশি মূল্যে সেখানে বিক্রি করে আসি। কোন কোন সময় ৫শ টাকা বেশি দামেও বিক্রি হয়। তিনি বলেন আমরা বিসিআইসিকে বারবার বলেছি আমাদের সার জাহাজে করে বিএডিসির মত নওয়াপাড়ায় পৌছে দেয়া হোক। কিন্তু বিসিআইসি সেটা করেনা। কয়েকবস্তা করে বরাদ্দ সার আনতে অনেক খরচ হয়ে যায়। এজন্য আমরা চট্রগ্রাম থেকে সার না এনে সেখানে বিক্রি করে দিই।’
মুবার্তা/এস/ই