By মুক্তি বার্তা
শেখ রাসেলের যতো আবদার ছিলো বাবার কাছে!
সোহেল সানিঃ “শেখ রাসেলের যতো আবদার ছিলো আব্বার কাছে। আব্বাও ওকে কাছে কাছে রাখতে চাইতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ওকে নিয়ে যেতেন। ও ভীষণ খুশী হতো। মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে আমার লেগে যেতো। আমি বলতাম, আমি ছোট, ও বলতো তুমি আগে ছোটো ছিলে, এখন আমি ছোটো। আমাদের সঙ্গে রাসেলেরও জার্মানিতে যাবার কথা ছিলো। মা ওকে ছাড়লো না।”
এ কথাগুলো ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, তাঁর আদুরে ভাই শেখ রাসেলের স্মরণে।
শেখ রেহানা লিখেছেন, সেদিন ছোট্ট শিশু হত্যায় কি আল্লাহর আরশ কাঁপেনি? পাখিরা গান ভুলে গিয়ে বেদনায় ডানা ঝাপটায় নি! বৃক্ষ, লতা,পাতা, ফুল কি কষ্টে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ওঠেনি?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের হৃদয়ষ্পন্দনকে স্তব্ধ করে এই দেশেরই কতিপয় দানব সদৃশ্য মানব ঘাতক হত্যার তান্ডবলীলায় মেতে উঠেছিলো। ঘৃণ্য, জঘন্য সেই দিন বাঙালি জাতির জন্যই চরম দুর্ভাগ্যের দিন। যেদিন শুধু রাসেলকেই নয়, ঘাতকদের বুলেট কেড়ে নিয়েছে তাঁর পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, মমতাময়ী মা, প্রিয় ভাইদের-ভাবীদের।
শেখ রেহানা লিখেছেন,
দশ বছরের আদুরে ছোট ভাই শেখ রাসেলের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা ২৯ জুলাই। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরি ধানমন্ডির বাড়িটিতে প্রবেশ করেই আঁতকে উঠেছিলাম। ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো চোখ, ঝাঁকিয়ে উঠেছিলো মন। কেঁপে উঠেছিলো বুক। পৃথিবীর সমগ্র কষ্ট অন্তরে চাপা দিয়ে আজ লিখেছি, রাসেলের সঙ্গে আমার সারাদিন খুনসুটি চলতো। একটা সাইকেল নিয়ে সে পড়ে থাকতো। যে শিশু বোঝেনা মানবিক জটিল ঘোরপ্যাঁচ, শুধু দেখতো সুন্দর চাঁদ, নীল আকাশের অপরূপ তারা, যে শুনতো পাখির গান, আর বুঝতো মানুষের ভালোবাসা, বোনদের আদর, মা-বাবার স্নেহ, ভাইদের মিষ্টি বকুনি, সেই অবুঝ শিশুকেও পাষণ্ড নরাধমরা হত্যা করেছে। বোধহয় ঘাতকরা ভেবেছিলো, এই শিশু ধীরে ধীরে একদিন বড় হবে, এবং একদিন লাখো কোটি মানুষ ওর মধ্যেই খুঁজে পাবে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে।
বড় বোন দুই শিশুসন্তানের মা-জননী শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানিতে গিয়েছিলেন শেখ রেহানা।
শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া তখন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। তাঁর কাছেই তাঁদের বেড়াতে যাওয়া। তাঁদের ২৩ আগস্ট দেশে ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যায় ইতিহাসের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বাবা-মা,ভাইদের, ভাবীদেরসহ নিকটতম আত্মীয় পরিজন হারানোর খবর শুনতে হয় জার্মানিতে বসেই। ফলে দুইবোনকে জীবন বাঁচাতে ভারতের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার কারণে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বড় বোন শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরলেও শেখ রেহানা ফেরেন ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি।
“যেভাবে হত্যা করা হয় রাসেলকে”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র
শেখ রাসেল। হত্যাযজ্ঞের মধ্যে এক ঘাতক তাকে নীচে নামিয়ে আনে। রাসেল দৌড়ে গিয়ে প্রথমে কাজের ছেলে রমা এবং পরে মহিতুল ইসলাম মহিতের হাত ধরে। সেখানেই রাসেল দেখতে পায় বড় ভাইয়া শেখ কামালের মৃতদেহ। মহিতুল ইসলাম মহিত। শেখ রাসেল মহিতকে জড়িয়ে ধরে বলছিলো, ‘ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো?’ মহিত বলেছিলো,’না, ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’
এই সময় এক ঘাতক মহিতের কাছ থেকে রাসেলকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, গেইটের কাছে পুলিশ বক্মে।
রাসেল কেঁদে কেঁদে শুধু মা’য়ের কাছে যাবার কথা বলছিলো। ঘাতকটি রাসেলকে এক সৈন্যের কাছে রেখে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ঘাতক আবার ফিরে আসে। ঘাতক এবার রাসেলকে বলে, চলো এবার তোমাকে তোমার মা’য়ের কাছে দিয়ে আসি। কোনো কাকুতি-মিনতিও ঘাতকের পাষণ্ড মন গলাতে পারেনি। রাসেলকে দোতালায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যেখানে পড়ে ছিলো প্রিয় বড় ভাবী সুলতানা কামালের মৃতদেহ। ছোট্ট শিশু মায়াবী মুখের রাসেল। সে বাঁচতে চেয়েছিলো। ঘাতকের বুলেটে লুটিয়ে পড়ার আগে দৌড়ে ভাবীদের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো, বাড়ির কাজের লোকদের ভিড়ে ছুটে গিয়ে লুকাতে চেয়েছিলো- বেঁচে থাকার ইচ্ছায়- কিন্তু পারে নি। পাষণ্ডরা শিশুটির বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলো।
বনানী গোরস্থানে সবার লাশ দাফনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা স্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল এম এ হামিদ পিএসসির বর্ননা মতে, সুলতানা কামালের কোল ঘেঁষে রাসেলের মৃতদেহ দেখা যায়। তার মাথার খুলির পেছন দিক একেবারে থেঁতলে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী আফম মহিতুল ইসলাম মহিতের ভাষ্যমতে সর্বশেষ হত্যাটি ছিলো শেখ রাসেলের আর শেখ কামাল ছিলো প্রথম হত্যা। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্ম। গতকাল গেলো তার জন্মদিন। তার আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
গণমানুষের অন্তরে, প্রতিটির শিশুর মনে, নিভৃতে চির-বিরাজমান শেখ রাসেল। তার মৃত্যু হয়নি। আকাশে বাতাসে, নদীর কলতানে, অরণ্যের প্রাণশক্তিতে মিশে আছে, থাকবে অনন্তকাল। কেননা সে মৃত্যুঞ্জয়ী।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মুবার্তা/এস/ই