By মুক্তি বার্তা
চিকিৎসা পদ্ধতি নয়,আত্মবিশ্বাসই ভয়কে নির্মূল করতে পারে
সোহেল সানিঃ চিকিৎসা পদ্ধতি আত্মপ্রত্যয় গড়ে তুলতে পারে না, পারে না ভয়কে নির্মূল করতে। পৃথিবীর কোনো ওষুধই দীর্ঘ জীবন পেয়ে বেঁচে থাকার তীব্র বাসনার মতো শক্তিশালী নয়। ভয় জিনিসটি আসল ও সত্যিকার অনুভূতি। ভয়কে জয় করার আগেই তা মনে গেঁথে যায়। এ অভিপ্রায় দীর্ঘায়ু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ট্যুলেন ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের ডঃ জর্জ ই বার্চের। করোনার মৃত্যুভীতি একটি মনের রোগ। সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও করোনা নিয়ে চরম হতাশাব্যাঞ্জক চিন্তাভাবনার ফলে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। এজন্য চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে সরবরাহকৃত গণমাধ্যমের খবরাখবরে দুর্বোধ্য শব্দ ও ভাষা প্রয়োগ করায় মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। ভুলে গেলে চলবে না, খবর পড়ার সময় মন নামক অত্যাশ্চর্য যন্ত্রটা কল্পনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে শব্দ ও বাক্যকে ছবির আকার দেয়। শব্দ ব্যবহারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মানুষের চিন্তা ভাবনায় তার ব্যবহৃত কথা, শব্দ ও বাক্যের কতখানি প্রভাব পড়ে। ভয় সত্যি এক শক্তিশালী ক্ষমতা, মানুষ জীবনে যা পেতে চায় ভয় তা পাওয়ার পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। করোনা আক্রান্তদের মধ্য থেকেই দুটি দিক পরিস্কার হয়ে উঠেছে। ভয় যাদের কাছে ভ্রুক্ষেপহীন, তারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। অথচ,ভয়েই আবা অনেকেই বাঁচার সুযোগ হারাচ্ছেন। মনস্তত্ত্ববিদরা মনে করেন, ভয় শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস করে, আয়ুকে স্তদ্ধ করে দেয়। ভয় অনিশ্চয়তা, আত্মপ্রত্যয়ের অভাব মানুষকে রোগগ্রস্ত করে ফেলে, শরীরে নানা রোগব্যাধির সৃষ্টি করে। নানাধরনের, নানা আকারের ভয় হয় মনের সংক্রম। শরীরের সংক্রমণের মতোই মনের সংক্রমণেরও দূর করার উপায় আছে। এক মনোবিদের ভাষায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নৌসেনাদের জন্য সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক ছিলো। নবনিযুক্ত নৌসেনাদের ৬ ফুট উঁচু বোর্ড থেকে ৮ ফুট গভীর জলে ঝাঁপ দিতে বলা হলো, সাঁতার বিশেষজ্ঞরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরলো। মনের ভয়কে হারানোর জন্য দরকার ছিলো জলে ঝাঁপ দেয়া, কিন্তু অনেককেই ‘হঠাৎ ধাক্কা’ দিয়ে বোর্ড থেকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিল। বোঝা গেলো অনিশ্চয়তা, বিলম্ব ভয় বাড়িয়েছিলো নৌসেনাদের মাঝে। তারা কৃতকার্য হলেন না। কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে, যতক্ষণ না সক্রিয় হয়ে ওঠা যায় ততক্ষণ ঐ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। আশাতেই সবের শুরু, তবে আশার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠলে জয়ী হওয়া সম্ভব। ভয় দূর করার জন্য কি উপায় অবলম্বন করা যায়, তা করোনাক্রান্তদের পন্থা অবলম্বন করাই যথেষ্ট। ভয়টাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। অন্যেরা কি ভাববে, কি বলবে সেই ভয় দূর করতে হবে। পজেটিভ হওয়ার পরও যে পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে, সেটার ওপরই বিশ্বাস রাখতে হবে। দুশ্চিন্তা না করে সময়ের সদ্ব্যবহার করে নিজেকে সুস্থ করা যেতে পারে। অন্যের ভয় দূর করার জন্য নিজের বলিষ্ঠ মনোবল প্রকাশ করুন এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন। ভয়কে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিন। কেনো ভয় পাচ্ছেন সেই কারণটা খুঁজে বার করুন। সক্রিয় হয়ে উঠুন। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভয়কে প্রকট করে, ভয়াবহ করে তোলে। মনোবিদদের মতে, আত্মবিশ্বাসের অভাবের মূলে থাকে স্মরণশক্তি পরিচালনা করার অক্ষমতা। মস্তিষ্ক অনেকটা ব্যাঙ্কের মতো। প্রতিমুহূর্তে ‘মনের ব্যাঙ্কে’ জমা হয় অজস্র চিন্তা-ভাবনা। এই চিন্তাগুলো বাড়তে বাড়তে স্মৃতি হয়ে যায়। আর তখন চিন্তা করতে বসলেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তখন মনের ব্যাঙ্ককে প্রশ্ন করুন ‘এ বিষয়ে কি আপনার কি জানা’? মনের ব্যাঙ্ক যে স্মৃতিগুলো জমা রেখেছেন, দেখবেন সেগুলোর বিষয়ে টুকরো টুকরো তথ্য দেবে। বিনাশমূলক চিন্তাভাবনা মনের দানব হয়ে ওঠার আগেই সেগুলোকে সমূলে উচ্ছেদ করে দিন। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের মনের গভীরে আতঙ্ক ও ভয়ের এক মিউজিয়াম গড়ে তুলেছে। বারবার বিনাশকারী চিন্তা ভাবনা করলে তা দানবের আকার নেয়, যা আত্মপ্রত্যয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, যার ফলে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারতে মৃত্যুর হার বেশী। কসমোপলিটান ম্যাগাজিনের একটি একটি প্রবন্ধ এক্ষেত্রে তুলে ধরছি। “দ্য ড্রাইভ টুওয়ার্ডস সেলফ ডেস্ট্রাকসন” (নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্রবণতা) শীর্ষক ওই প্রবন্ধে এ অ্যালিস মালক্যহে নামক এক বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে প্রতিবছর ত্রিশ হাজারেরও বেশি আমেরিকান আত্মহত্যা করে এবং লক্ষ্মাধিক আমেরিকান আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আত্মবিশ্বাসহীনতাই একটা রোগ হয়ে দাঁড়ায়। মনস্তত্ত্ববিদ এক চিকিৎসক এক রুগীকে একটা ছবি দেখিয়ে তার মানে জিজ্ঞেস করেন, রোগীটি বলেন, “মনে হচ্ছে আজ রাতে ঝড় উঠবে।” এটা ছিলো নিরাশাজনক প্রতিক্রিয়া। সূর্যাস্তের ওই ছবিটিতে সূর্যটা খানিকটা দেখা যাচ্ছিলো। সঙ্গে ছিলো পাথুরে সমুদ্র সৈকত। সুদক্ষ হাতে আঁকা ঐ ছবিটির সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত যেকোনো ব্যাখ্যাই দেয়া যায়। এরপর মনোবিশারদ বললেন, ছবিটির যে যেমন ব্যাখ্যা করবে তাই হবে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। অধিকাংশ মানুষ ঐ ছবিতে সূর্যোদয় দেখতে পায়। আর মন-মরা ভীতসন্ত্রস্ত বিষন্ন মানুষ প্রায় সবসময়ই ছবিতে সূর্যাস্ত দেখতে পাবে। ওই মনস্তত্ত্ববিদ জানান,”আমি মনোবিদ হলেও আমার পক্ষে মানুষের সঞ্চিত স্মৃতিগুলো সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে রুগীর সহযোগিতা পেলে তার মনের ভেতরে সঞ্চিত ভয়ভীতি হতাশা দূর করতে সক্ষম। ভয়ভীতি রোমন্থন না করে সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে সাহায্য করা যায়। কিছুদিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি ঘটানোও যায়। রোগীটিকে এরপর আমি প্রতিদিন সুখানুভূতির তিনটি কারণ লিখে রাখতে বলি। সপ্তাহে তা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করি। দেখা গেলো, মৃত্যুভীতি কাটিয়ে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। মানে সেই রোগী মনের ভয়ভীতি রোমন্থন বন্ধ করে দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। প্রথিতযশা মনোবিদ ডঃ মেলভিন এস হ্যাটউইকের মতে, ভয়ভীতির আতঙ্কের অনুভূতি মনে না করলে সহজেই ভয়কে জয় করা যায়।কোনকিছুকে ভয় পাওয়া এক ভয়ানক রোগ। ভয়কে অতিক্রমের উপায় আছে। যদি ‘সঠিকভাবে বোঝার’ চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেই ভয়কে তাড়িয়েছে,তাই মৃত্যুর হারও নগণ্য।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মুবার্তা/এস/ই