By মুক্তি বার্তা
যশোরের চৌগাছা ছিল সবচেয়ে নীল উৎপাদনমুখী উর্বর এলাকা- সাজেদ রহমান
সাজেদ রহমান: চৌগাছার সবচেয়ে বড় নীল কুঠি ছিল কাঠগড়া কনর্সান যার অধীনে ছিল খালিসপুর, চৌগাছা, গুয়াতলী,কাঁদবিলা, ইলিশমারি । এখন কাঠগড়ায় কোন কিছু নেই। তবে ইতিহাস আছে। যশোরের চৌগাছা ছিল সবচেয়ে নীল উৎপাদনমুখী উর্বর এলাকা। এছাড়া যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা থাকায় ইংরেজরা এখানে নীলকুঠি তৈরি করেন। এর অধীনে ইলিশমারি, ভগবানপুর এর পাশে কপোতাক্ষ নদের কূল ঘেঁষে নীল কুঠি গড়ে তোলেন। যেখানে শত শত লোক কাজ করত আর দালালদের খপ্পরে নিঃস্ব হতে থাকতো কৃষক দল।
আর এ কারণেই নীল বিদ্রোহের বারুদ বিষ্ফোরিত হয় চৌগাছা থেকে। যার নায়ক ছিল চৌগাছার ভেন্নবেড়ে গ্রামের পিতম্বর বিশ্বাস ও দ্বিগম্বর বিশ্বাস।
যশোর এবং নদীয়ার কপোতাক্ষ, ইছামতি, বেতনা, কোদলা, চিত্রা, নবগঙ্গা, বেগদলা, নাওডাঙ্গা, ভৈরব, ফটকী, চুর্নি, জঙ্গলী ভগীরথী, যমুনা, হরিহর, কুমার, নদীর তীরে কয়েক মাইল পর পর নীর কুঠি স্থাপন করা হয়েছিল।
নীল বিদ্রোহের সময় সমগ্র খুলনা ছিল যশোরের অধীনে। অন্যদিকে কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম পার এবং যশোর বনগাঁ সড়কের ঝিকরগাছা থেকে উত্তরাংশ বনগাঁসহ ছিল নদীয়া জেলার অর্ন্তভুক্ত। এছাড়া কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ছিল নদীয়ার মধ্যে। পরে বনগাঁ মহাকুমাকে যশোরের আওতাভুক্ত করা হয়।
যশোর, নদীয়া, ২৪ পরগনা জেলার কৃষক-জনতা তিনটি বিদ্রোহে যোগ দেন। এ তিনটি বিদ্রোহে বিদ্রোহের বহ্নি ছড়ায় চৌগাছা এলাকার কৃষককুলদের সাথে দিগম্বর বিশ্বাস ও পিতাম্বর বিশ্বাস।
তাঁরা গ্রামে গ্রামে রাতের আধাঁরে বের হত কৃষক কুলের বিদ্রোহ করার জন্য। যাদের ঘরে খাবার থাকতো না, তাদের খাবার দিত, যাদের বস্ত্র থাকতো না, তাদের বস্ত্র দিত, যাদের অস্ত্রের প্রয়োজন তাদের অস্ত্র দিত। আর বিদ্রোহের দাবানলদাহ প্রজ্জলিত করতো কুঠিতে কঠিতে। বিদ্রোহের চুড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৮৫৯-৬০ সালে। যা ছিল প্রকৃত পক্ষে কৃষক বিদ্রোহ। কাটগড়া কনর্সানে নিম্নপদে চাকরি করতেন চৌগাছা দিগম্বর বিশ্বাস নামে এক যুবক। অন্যদিকে এসময় অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ হতো। এর সম্পাদক ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ। যাঁর বাড়ি ছিল চৌগাছার পাশে অমৃতবাজারে। শিশির কুমার ঘোষ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়মিত পত্রিকায় তুলে ধরতেন। দিগম্বর বিশ্বাসের সহযোগিতায় যখন কৃষকরা আন্দোলন শুরু তখন তিনি তার সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করেন। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস শিশিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফলে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের বিশ্বাসে আর প্রগাঢ় রূপ ধারণ করে।
কাঠগড়া কনসার্ন এর অধীনে ৭৩ হাজার ৪৩৯ জন কর্মচারী ও কৃষক ছিল। এটা ছিল বাংলাদেশের প্রধান কনসার্ন গুলোর অন্যতম।
১৮৫৮ সালে বিচ্ছিন্নভাবে নীল বিদ্রোহী দেখা দেয়। যশোর নদীয়ার কোন কোন এলাকার কৃষকরা ঘোষনা দেন তারা আর নীল চাষ করবেনা। দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস বরিশাল থেকে লাঠিয়াল আনে বিদ্রোহের বারুদ তীব্র থেকে তীব্রতর করার জন্য।
কৃষকদের উত্তেজিত করার কারণে দিগম্বর বিশ্বাসকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেবার জন্য ইংরেজরা ঘোষনা দেন অনেক টাকার পুরষ্কার। ১৮৫৯ সালে এ অঞ্চলের কৃষকরা নীলচাষ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। এসময় নীল বিদ্রোহের সূর্য সৈনিক দিগম্বর বিশ্বাস এর নেতৃত্বে বনগাঁ থানা লুট করে ৬ টি বন্দুক করায়ত্ব করে এবং কৃষকদের নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে।
এই বিদ্রোহ দমনার্থে তৎকালীন চৌগাছা অঞ্চলের কাঠগড়া কনসার্নের ইংরেজ নীলকর ম্যাকেঞ্জী ঝিকরগাছা কনসার্নের লার্মার ও ফরলং বড় লাটের নিকট হতে ৫০০ শসন্ত্র সৈন্য যশোরে এনে রাখেন। এসময় বারাসাতের ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন এ্যাসলি ইডেন। তিনি ছিলেন কৃষকদের প্রতি দারুন সহানুভূতিশীল। ১৮৫৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষনা দেন, নীল চাষের জন্য নীলকরদের সাথে চুক্তি করা বা না করা সম্পূর্ণ কৃষকদের ইচ্ছাধীন। এর পরপরই নদীয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট ডব্লিই জি হারসেলও একই ঘোষনাপত্র দেন কৃষকদের পক্ষে। কৃষকরা এ খবর দ্রুত পৌছে যায় কৃষকদের কাছে।
এই ঘোষনার পর চৌগাছা ও তার আশেপাশের নীল চাষিরা নীল চাষ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। ম্যাকেঞ্জি চৌগাছার তাহেরপুর চিনি কারখানার পাশে একটা অস্ত্রাগার তৈরি করে। ভগবানপুর ও ইলেশমারি কাছে কপোতাক্ষ নদের পাড়ের নীল কুঠিতে জনবল ও অস্ত্রসস্ত্র বৃদ্ধি করে কৃষকদের এ বিদ্রোহ দমনের জন্য। ১৮৬০ সালে লর্ড ম্যাকেঞ্জির হুকুমে ভগবানপুর ও ইলেশমারির কুঠিতে এনে রাখা লাঠিয়ালরা অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে নীল বিদ্রোহী চাষীদের ধরে আনার জন্য গ্রামে গ্রামে বের হয়।
তারা কয়েকজনকে ধরে নিয়ে আসার পর নারায়নপুর, বাদেখানপুর, বড়খানপর, জিতারপুর, মদনপুর, তাহেরপর, দেবিপুর, হাকিমপুরের বিদ্রোহী বীর কৃষক- কৃষাণী লাঠি সোটা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। ইংরেজদের বিপক্ষে এই বিদ্রোহ দেখে লর্ড ম্যাকেঞ্জি তাহেরপুর চিনি কারখানা থেকে নৌকা যোগে চৌগাছা হয়ে ঝিকরগাছা দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। নীল চাষিরা ইলেশমারি, ভগবানপুর কুঠি রাতের আধাঁরে গুড়িয়ে দেয়। চৌগাছা থেকে ইংরেজ নীলকরদের নীল চাষ চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর দিগম্বর বিশ্বাস নারায়নপুর মাঠে কৃষকদের সাথে মিলিত হন। চৌগাছা তথা নীল বিদ্রোহের প্রবাদ পুরুষ দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। যাঁরা নীল বিদ্রোহের অবিচ্ছেদ অংশ, তাঁদের নামে চৌগাছায় নেই কোন প্রতিষ্ঠান। নেই কোন ভাস্কর্য। এ জন্য জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জা লাগে। যদিও জানি এটা করতে গেলে লাগবে রাজনৈতিক সিন্ধান্ত। এমন কি কেউ নেই, যারা এটি পুরন করবে?