By মুক্তি বার্তা
যশোরে নারী আন্দোলন…প্রথম পর্ব।
সাজেদ রহমান: ১৯২২ সালে অসহযোগ সত্যাগ্রহের সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সেই আন্দোলনের জন্য প্রচার ও অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যশোরে আসেন। স্থানীয় ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে স্ত্রী-পুরুষের বিরাট সভায় তিনি বক্তব্য রাখেন। দেশবন্ধুর আবেদনে বহু মহিলা সভাস্থলেই নিজেদের গায়ের গহনা খুলে দেশবন্ধুর তহবিলে দান করেন। যশোরে মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সুচনা হয় সেইভাবে।
কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় এক তেজস্বিনী মুসলিম মহিলার(তাঁর নাম এখন আর জানা যায় না) নেতৃত্বে যশোর কালেক্টরেটের সামনে বিলাতি কাপড়ের এক বহ্ন্যৎসব হয়। তার ফলেও জনমনে বিশেষ উম্মাদনার সৃষ্টি হয়। ১৯২৭ সালে কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু যশোর সফরে এসে প্রথমে জেলা বোর্ডের মাঠে এবং পরে সম্মিলনী স্কুলে মহিলাদের সভায় তীব্র জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে মহিলাদের অনুপ্রাণিত করেন। এমনি করে যশোরের মহিলার স্বদেশী আন্দোলনে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ হন।
১৯৩০-৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সময় যশোরের মনোরমা বসু, রাইপ্রিয়া ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী, গিরিবালা ঘোষ, প্রতিভা দত্ত, রাণীবালা ঘোষ, ননীবালা বসু, আশালতা আশা, তরুবালা,নড়াইলের সরোজিনী ঘোষ, হেমলতা ঘোষ প্রমুখেরা আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। চারুশীলা ধর, রাধারানী বসু, লীলা বসু, নড়াইলের নির্মল নলিনী ঘোষ, রাজঘাটের কনকলতা মজুমদার প্রমুখেরা অসংখ্য সংগ্রামীদের সঙ্গে পুলিশী অত্যচার অগ্রাহ্য করে আইন ভঙ্গের মাধ্যমে পিকেটিং, সভা, শোভাযাত্রা, সরকারি অফিসে পতাকা উত্তোলন প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করে বিপুলভাবে আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করেন।
তিরিশের দশকে যশোরে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন বহু মহিলা, তরুণী ও ছাত্রীরা সমবেত হয়ে লাবণ্যপ্রভা মিত্রকে সভানেত্রী এবং চারুশীলা ধরকে সম্পাদিকা করে ‘‘নারী মঙ্গল সমিতি’’ গঠন করেন এবং তার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নাট্যাভিনয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মধারার সাহায্যে যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, বনগ্রাম, পাঁজিয়া, রাজঘাট প্রভৃতি অঞ্চলে সমিতির ক্রিয়াকলাপ প্রসারিত করেন।
যশোর শহরে জ্যেতির্ময়ী সেন, ক্ষণপ্রভা নাগ, আমিনা খাতুন, চারুশীলা ঘোষ, শিক্ষয়িত্রী মলিনা নিয়োগী ও আনজুমান বেগম এবং তরুণী ও ছাত্রীদের মধ্যে প্রীতিলতা গণ, কনক দাশগুপ্ত, সাধনা দাশগুপ্ত, গৌরী মিত্র, গীতা রায়চৌধুরী, পরিমল ঘোষ, নিভা মজুমদার, রেণু দত্ত প্রমুখেরা অনেকে সমিতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন এবং সমিতির সভ্যা হন। এই সব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মধারার মধ্য দিয়েই ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪২-এর মধ্যে মহিলারা বিপুল সংখ্যায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল হন। ক্রমে একদিকে মনোরমা বসু, চারুশীলা ধর, অমিতা(বেলা) মিত্র প্রমুখের নেতৃত্বে কংগ্রেস আন্দোলনে মহিলাদের যোগদান যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি অন্যদিকে বামপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ কৃষক সমিতি, কমিউনিষ্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশনের পতাকাতলে মিলিত হয়ে বহু তরুণী ও ছাত্রীরা ব্যাপকভাবে বামপন্থী আন্দোলনগুলোতে যোগ দিতে থাকেন।
১৯৩৭ সালে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যশোর জেলা ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। তাতে গৌরী মিত্র, গীতা রায়চৌধুরী(মুখার্জী), রেণু দত্ত(মিত্র) নিভা মজুমদার, সুধা পিপলাই(চ্যাটার্জী), বেলা ঘোষ(মিত্র), প্রমুখ ছাত্রীরা সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ১৯৩৮ সালে আন্দামানের বিপ্লবী বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাঁদের মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে যখন তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে তখন সেই আন্দোলনে যশোরের জাতীয়তাবাদী মনোরমা বসু, বেলা(অমিতা) মিত্রদের সঙ্গে উপরোক্ত বামপন্থী কর্মী ও ছাত্রীরা সর্বশক্তি নিয়ে যোগ দেন। আন্দোলন সফল হয়।
এই সময় বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে যশোর জেলা ‘‘মহিলা আত্নরক্ষা সমিতি’’ গঠিত হয়। মহিলা ছাত্রীরা বিরাট মিছিল করে শহর পরিক্রমা করেন। শ্রীমতি গোলাপ কামিনী রায়চৌধুরীর(অনিলা দেবীর মা এবং গীতা রায়চৌধুরীর পিতামহী) নেতৃত্বে ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে সভা ও বক্তৃতাদি হয়। সেই সভায় চারুশীলা ধর, মনোরমা বসু, লীলা বসু, ভুবন মোহিনী মিত্র, গীতা রায়চৌধুরী, গৌরী মিত্র, অমিতা মিত্র, অনিমা ঘোষ, অরুণা রায়, শান্তি দত্ত প্রমুখদের নিয়ে আত্নরক্ষা সমিতির এক কর্মসমিতি গঠিত হয়। সমিতির সভানেত্রী হন লাবণ্যপ্রভা মিত্র। কিছুদিনের মধ্যে রাইপ্রিয়া ঘোষ, লক্ষ্মীপ্রিয়া ঘোষ, কনক দাশগুপ্ত, অনিলা দেবী, অশোকা ঘোষ, রেবা নাগ প্রমুখেরা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। বিভিন্ন অঞ্চলে সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। পাঁজিয়ার বিভা বসু, পদ্মা রায়, নড়াইলের রীতা দত্ত, চাঁপা বসু, দুর্গা ভট্রাচার্য, অনিমা বিশ্বাস প্রমুখেরা সমিতিভুক্ত হন।
ক্রমে সমিতির কর্মীরা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংগ্রামে, নারীমুক্তি আন্দোলনে এবং সেই সঙ্গে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করেন। উপরন্ত কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। সমিতির কর্মধারা সুত্রে কলকাতা থেকে প্রখ্যাত মহিলা নেত্রী মণিকুন্তলা সেন, রেণু চক্রবর্তী, লতিকা সেন প্রমুখ কমিউনিষ্ট নেতৃবৃন্দ কয়েকবার যশোরে এসে জেলার কর্মীদের নানা ভাবে সহায়তা করেন। কয়েকবার শ্রীসুকুমার মিত্রের যশোরের বাড়িতে এসে কমঃ মুজফফর আহমদ, ডাঃ রণেন সেন প্রমুখ কমিউনিষ্ট পার্টির প্রাদেশিক নেতৃবর্গ মহিলা কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা আলোচনা ও বৈঠক করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪২-৪৩ সালে ‘‘যশোর জেলা সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’’ গঠিত হয়। অনিলা দেবী, গীতা রায়চৌধুরী, গৌরী মিত্র, হামিদা খাতুন, রেণু দত্ত, বেলা ঘোষ প্রমুখেরা সেই সমিতিতে যোগদান করে সমিতিকে সক্রিয় ও শক্তিশালী করেন।
উল্লেখ করা যায় যে, উত্তরকালে, দেশ ভাগ হবার পর উপরোক্ত সংগ্রামীদের মধ্যে শ্রীমতি কনক দাশগুপ্ত(মুখার্জী), গীতা রায়চৌধুরী(মুখার্জী, শ্রীমতি অনিলা দেবী প্রমুখেরা ছাড়াও আরও অনেকে রাজনীতি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশসেবায় গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখেন। তাঁদের কয়েকজনের এবং আরও অনেক বিশিষ্ট সংগ্রামীদের কথা লেখা যায়। ধারাবাহিক লেখার ইচ্ছা আছে। পরবর্তীতে লিখব।
তথ্য সুত্র: যশোর খুলনার ইতিহাস-সতীশচন্দ্র মিত্র, বাঙালীর ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, আত্নচরিত-কৃষ্ণকুমার মিত্র, বাংলাদেশের ইতিহাস-রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা-নরহরি কবিরাজ, বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি- যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, ‘‘সংসদ চরিতাভিধান’’।