আজঃ শুক্রবার ● ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১ ● ২৬শে এপ্রিল ২০২৪ ● ১৬ই শাওয়াল ১৪৪৫ ● সন্ধ্যা ৬:৩৫
শিরোনাম

By: মুক্তি বার্তা

চৌগাছায় করোনায় মৃত হিন্দু বৃদ্ধার সৎকার করলেন মুসলমান যুবকরা

ফাইল ছবি

চৌগাছা প্রতিনিধিঃ
যেকোনো কারনে সন্তাানকে বাচাতে বাবা-মায়ের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বিপদে ভাইবোনের একে অপরের জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয় এমনকি প্রেমের কারনে প্রেমিক প্রেমিকার একসাথে আতœহত্যা বা জীবন উৎসর্গ করা ঘটনাও আছে বেশ। এসকল ঘটনায় ভালবাসা ও মায়া মমতার কাছে যেনো মৃত্যুরই পরাজয় ঘটেছে বারবার।
কভিড-১৯ বা করোনা মহামারিতে সেই ভালবাসার কোনো ব্যতয় ঘটেনি। তাইতো মরন ব্যাধি (ছোয়াচে) করোনা আক্রান্ত সন্তানকে বাচাতে আইসিইউর খোজে সন্তানকে কোলে তুলে পাগলের মতো ছুটে চলা বাবা, মাকে বাচাতে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেধে নিজ মটর সাইকেলেই মাকে বসিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা ছেলে, করোনা আক্রান্ত স্বামীকে বাচাতে তার মুখে স্ত্রী নিজের মুখ লাগিয়ে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা আরো কতো দৃশ্য। আবার করোনায় মৃত মা/বাবাকে জড়িয়ে ধরে সন্তানের আহাজারি,মৃত প্রায় বাবাকে মুখে শেষ পানি দিতে শত বাধা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে মেয়ের এগিয়ে যাওয়া এমনকি করোনা আক্রান্ত একজন জনপ্রতিনিধিকে বাচাতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়কে তুচ্ছ করে অন্য এক জনপ্রতিনিধির অক্লান্ত পরিশ্রম এরকম হাজারো জানা অজানা হৃদয় বিদারক দৃশ্য শুনছে বা দেখছে বিশ্ববাসি।
মানবতার প্রশ্নে সরকারের পাশাপাশি,বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে কতোযে মহৎ মানুষেরা অসহায় মানুষদেরকে সাহায্য করতে নিজ অর্থায়নে এগিয়ে এসেছেন তার সঠিক সংখ্যা জানানেই। মরনব্যাধির ভয়কে পরোয়া না করে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে ফেলে যাওয়া অন্য সম্প্রদায়ের মৃত দেহ সৎকার করছে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ,বিভিন্ন মাধ্যমে এসকল চিত্র এখন অহরহ দেখা যাচ্ছে।
তেমনি গত শুক্রবার যশোরের চৌগাছায় করোনায় মৃত্যু হওয়া একজন হিন্দু বৃদ্ধার সৎকার করলেন মুসলিম যুবকরা। এদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনায় আক্রান্ত জোসনা রানী নামে একজন ৭০ বছরের হিন্দু বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে প্রায় ৪ ঘন্টা লাশটি সেখানেই পড়েছিল। ৩ সন্তানের মা জোসনা রানী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশের মহল্লার মৃত নারায়ন কর্মকারের মেয়ে। স্বামী সন্তোষ কর্মকার আগেই গত হয়েছেন। আপন ভাই চৌগাছা বাজারের সেনকো জুয়েলার্সের মালিক রবিন সেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ি। মৃতের ছেলে ও একটি মেয়ে মায়ের লাশ দূর থেকে দেখলেও আপন ভাই বা সম্প্রদায়ের অন্য কাউকেই মৃতের সৎকারে দেখা মেলেনি। তাই সাম্প্রদায়িক সৎকারের রীতিনীতি না জানলেও শেষ পর্যন্ত মুসলিম যুবকরাই শ্বশানে জোৎসা রানীর সৎকার করলেন।
সেদিন হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার নিলুফার ইয়াসমিন বললেন, জোৎসা রানী শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে মারা যান। মৃত্যুর পরে আমি তার ছেলেকে কয়েকবার ফোন করেছিলাম।”
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.লুৎফুন্নাহার লাকি বলেন,“ জোৎসানা রানীর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমরা তার ছেলেকে বলেছিলাম আরো ভাল চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে। কিন্তু সে বললো রোগীর সাথে থাকার মতো কেউ নেই। আর মৃত্যুর প্রায় ২ ঘন্টা পরেও পরিবারের কেউ লাশ নিতে আসেননি। পরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অগ্রযাত্রাকে জানানো হলে তারাই মৃতদেহটি নিয়ে সৎকার করেন।
অবশ্য পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ বলয় চন্দ্র পাল বললেন,“বিষয়টি দুঃখজনক। তবে মৃত্যুর বিষয়টি আমাদেরকে কেউ বলেনি।”
উল্লেখ্য গত বছর করনো মহামারি শুরুর পর এই “অগ্রযাত্রা” সংগঠনটি উপজেলা প্রশাসনকে সার্বিক সহোযোগিতা করার পাশাপাশি এযাবৎ করোনা ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরন করা প্রায় ২০জনকে সৎকার করেছে। সংগঠনটির উপদেষ্টা পৌর মেয়র নূর উদ্দীন আল মামুন হিমেল,সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ি হাসিবুর রহমান হাসিব সাধারন সম্পাদক জাহিদসহ সদস্য হোমিও ডাক্তার ফয়সাল এবং হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স চালক আলমরাই সর্বদা করোনায় মৃতদের সৎকার করে থাকেন। তাইতো শুরু থেকে এপর্যন্ত করোনার সন্মুখ যুদ্ধের প্রথম সারির ৫/৬ জনের নাম বলতে হলে পৌর মেয়র হিমেল,হাসিব,জাহিদ,এ্যাম্বুলেন্স চালক আলম,হোমিও ডাক্তার ফয়সাল,রাজু এদের নামই বলতে হয়। করোনায় আক্রান্তদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ি সকল কাজ সম্পন্ন করে তাদের দাফন (কবরস্ত) পর্যন্ত সকল কাজে হাসিবদের সাথে অংশগ্রহন করেন মেয়র হিমেল।
সেই ঘটনার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জোসনা রানীর মৃত্যুর ৪ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও যখন পরিকারের কেউ লাশ নিতে আসেনি তখন সংবাদ আসে অগ্রযাত্রার কাছে। সভাপতি হাসিব পৌর মেয়র হিমেলের পরামর্শে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলি এনামুল হক এর সাথে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করেন। এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলি এনামুল হক ও চৌগাছা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সবুজের সার্বিক সহোযোগিতায় হাসিব,জাহিদ,ফয়সাল এবং এ্যাম্বুলেন্স চালক আলমরাই (করোনায় মৃত লাশ বহনযোগ্য ব্যাগে ভরে) পৌরসভার পান্টিপাড়া শ্বশানে নিয়ে সৎকার করেন।
মানুষ মানুষের জন্য কথাটি মাথায় নিয়ে ২০১৪ সালে “অগ্রযাত্রা”র যাত্রা শুরু হয়। মানুষের কল্যানে প্রথমে রক্তদান কর্মসূচি দিয়ে আরম্ভ করা সংগঠনটির খাতায় রক্ত দিতে ইচ্ছুক এমন মানুষের তালিকায় এখন ৮০০ জনের নাম।
মানুষের কল্যানে যারা মৃত্যু ভয়কে তোয়াক্কা করেনা ইতিহাসে তারা বীর খ্যাতি নিয়ে সর্বদাই বেচে থাকেন। দেশে করোনা যুদ্ধের এই প্রকৃত সন্মুখ যোদ্ধারাই দিনশেষে ইতিহাসে চিরস্মরনীয় ও বরনীয় হয়ে থাকবেন।

মুবার্তা/এস/ই

 

 

 

ফেসবুকে লাইক দিন