আজঃ শুক্রবার ● ২৯শে চৈত্র ১৪৩০ ● ১২ই এপ্রিল ২০২৪ ● ২রা শাওয়াল ১৪৪৫ ● রাত ১০:৪৪
শিরোনাম

By: মুক্তি বার্তা

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির নেপথ্যে অপ্রকাশিত  নানা তথ্য! 

ফাইল ছবি

সোহেল সানিঃ “রক্ত দিয়েই যদি স্বাধীনতার মূল্য নিরূপণ করা হয় তাহলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েগেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এমন স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর কয়টা  দেশ ও জাতি   পারছে আমার জানা নেই, যার  মহাননেতা শেখ মুজিবুর রহমান।”
বৃটেনের বিখ্যাত সংবাদপত্র New Statesmen এর সম্পাদক কিংসলি মার্টিন তাঁর স্বনামে প্রকাশিত এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
অথচ, তখনো রমনার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পূর্বদিগন্তে বিজয় পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেনি।
রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ” আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকামিলা কর।” সেই রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণে বাঙালির বিজয় হলেও তা অপূর্ণ রয়ে যায় বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানে কারাগারে থাকায়। তাঁকে নিয়ে ঘরেবাইরে উৎকন্ঠা আর কতশত গুজব।
মুজিব নগর সরকারের সঙ্গে
ছাত্রলীগ ও মুজিব বাহিনীর সৃষ্ট দ্বন্দ্ব গুজবকে প্রকট করে তুলে।
মুজিব বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে জনসভা  করার ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন এমন গুজব  রটে যায়।
এরকম পরিস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমদ ছুটে যান বেগম মুজিবের কাছে,ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের বাড়িতে।   তাজউদ্দিন মুক্তির বিষয়ে সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে বেগম মুজিবকে অবহিত করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। তারা বলে শেখ মুজিবের যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে ফলাফল হবে ভয়াবহ।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি করাচির জনসভায় পাকিস্তানের নবাগত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের মুক্তিদানের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষনা করেন। ২২ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার মুজিব নগর থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করে।
ঢাকায় এসে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) ওঠেন। পদচ্যুত হবার আশঙ্কায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ গিয়ে ওঠে তার আগামসি লেনের বাড়িতে। তাজউদ্দিন নতুন মন্ত্রিসভা করে মোশতাকের স্থলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করেন আব্দুস সামাদ আজাদকে।  মোশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছিলেন। আগেই জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতারূপে মোশতাককে বাদ দিয়ে লন্ডনে দায়িত্বরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পাঠানো হয়। তারপরও
আইনমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে বলা হয় মোশতাককে। কিন্তু  তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে  বিবিসির খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু  একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে রয়েছেন। খবরে মানুষের  আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে নন নেতৃবৃন্দ। বিবিসি দ্বিতীয় খবরে বলে- বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ৬ টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। সকাল দশটায় দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বিরল অভিবাদন জানিয়েছেন। ওদিন সন্ধ্যায় ববঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ৯ জানুয়ারি তাজউদ্দিন বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার সময়সূচি অবহিত করেন। ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন দিল্লিতে পৌঁছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ভারতীয় একটি বিমানে কোলকাতায় একঘন্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল চারটার দিকে ঢাকা পৌঁছবেন বলে খবর চলে আসে। বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করে বলেন, দিল্লিতে বিমানে পরিবর্তন করলে বৃটেন মন:ক্ষুন্ন হতে পারে। তাঁর বৃটিশ বিমানেই ঢাকা আসা উচিত। ততক্ষণে তাজউদ্দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ফোন করে বেগম মুজিবের পরামর্শ অবহিত করেন। সেই মতে ১০ জানুয়ারি দুপুরের দিকে বৃটিশ রাজকীয় বিমান “কমেট” দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভা বিশাল অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এক বিরাট সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ। কারো জন্যে কোনো ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না। মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়, অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ওপর শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে।
বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি  “সাদাকমেট” বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রিয়নেতাকে অভিবাদন জানানোর জন্য মন্তিসভার সদস্যরা আগেই উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ ছাড়া  মুজিববাহিনী ও ছাত্রলীগ তথা স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন, অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ । সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে।
ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রিত ট্রাকটিতে গাদাগাঁদি করে দন্ডয়মান ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিকাল তিনটায় অবতরণ করে বিমানটি।
ছাত্রলীগ নেতারা ব্যূহের মতো করে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকে। লাখ লাখ মানুষের উপচে পড়া ভিড় ঢেলে যখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উপবিষ্ট, তখন জয়বাংলার গগণবিদারি শ্লোগানে মুখরিত ময়দানের জনস্রোত। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের কন্ঠ মাইকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জে উঠে শোনায় শেখ মুজিবের উপস্থিতির বার্তা। তোফায়েল আহমেদ ৬৯ গণঅভ্যুত্থানের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি যে বঙ্গবন্ধু খেতাব দিয়ে ছিলেন সেই অভিধায় শেখ মুজিবকে অভিসিক্ত করে জনসমুদ্রে বললেন, ‘ভাইসব’ বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধুর এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে সবাই বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আশেপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনীর হাত যে কোন জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে।কড়া নজর রাখবেন। তোফায়েল আহমেদের এ বক্তৃতার মধ্যেই
চোখের পলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভামঞ্চে এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিথর নিরব হয়ে থাকলেন। ময়দানে উত্তেজনার উদ্বেল আনন্দ ধ্বনি। বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আমি বলেছিলাম, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।,,,,,, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালির প্রাণ থাকতে এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।”
পাকিস্তানি জেলখানায় নিজের বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার ফাঁসি র হুকুম হয়েহয়েছিলো, আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়েহয়েছিল, আমি মুসলমান, আমি জানি মুসলমান একবারই মরে, তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়ও আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ,  বাংলা আমার ভাষা।
ইন্দিরা গান্ধীগান্ধীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জাতির পিতা  বলেন, আমি যখন চাইবো ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য বাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবেন। ভাষণের একপর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি” উদ্ধৃতি করে বলেন, এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে।
আপনাদের মুজিব ভাই আহবান জানিয়ে ছিলেন আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। বাঙালি বীরের জাতি। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পদানত করতে পারবে না। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করে বলেছেন, সম্ভব হলে আমি যেন লুস ফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। তাকে বলেছি, আমার জনসাধারণের নিকট আমি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। এখন আমি বলতে চাই , ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ সেই স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায় তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য শেখ মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।
বঙ্গবন্ধু জনসভা শেষ করে সদলবলে ছুটে যান শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। মাজার জিয়াররত করে  ওখান থেকে যান শহীদ মিনারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা। ওখান থেকে ৩২ নম্বরের সড়কের ধানমন্ডির বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেখানে ফেরেন বাবা, মা, ভাইবোন স্ত্রী, পুত্র-কন্যা মাঝে । এরপর ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপে বসেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্কের নেপথ্য ঘটনাগুলো শুনেন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে যান শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে।  এরপর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা জারি করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এভাবেই শুরু হয় জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিনির্মানের স্বপ্ন।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মুবার্তা/এস/এ

ফেসবুকে লাইক দিন