আজঃ সোমবার ● ৯ই বৈশাখ ১৪৩১ ● ২২শে এপ্রিল ২০২৪ ● ১২ই শাওয়াল ১৪৪৫ ● বিকাল ৩:৫৭
শিরোনাম

By: মুক্তি বার্তা

রাজনীতিকদের কটুক্তি হজমের  মানসিকতা থাকা চাই  

ফাইল ছবি

সোহেল সানি: “কুকুর সোহরাওয়ার্দীর মুন্ডু চাই, সাদা চামড়ার রক্ত চাই। শুধু তাই নয়, বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্ত্রীকে অপহরণ করে একজন হিন্দু মুচির সঙ্গে, গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজের স্ত্রীকে অপহরণ করে একজন পাঠানের সঙ্গে,ভারতভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের স্ত্রীকে একজন মুসলিম লীগারের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হোক। পরে সবার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হোক।”
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার পোস্টারের ভাষা। যা জয়া চট্টোপাধ্যায় ফুটিয়ে তুলেছেন “বেঙ্গল ডিভাইডেড” গ্রন্থে।
মহাত্মা গান্ধীর সামনে সেদিন এমন ভাষা ব্যবহার করে দাঙ্গায় লিপ্ত হয় চরমপন্থী হিন্দুরা।
১৬ আগস্ট ছিল মুসলিম লীগের “ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে।” বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সরকারি ছুটি ঘোষণা কেন্দ্র করে শুরু হয় দাঙ্গা। লাখো হিন্দু- মুসলমানের রক্তের স্রোত বয়ে চলে রাজধানী কোলকাতার অলিগলিতে।
সোহরাওয়ার্দী ও শরৎচন্দ্র বসুর স্বাধীন যুক্তবাংলার প্রস্তাব মহাত্মা গান্ধী সমর্থন দেন। ফলে কংগ্রেস  চরমভাবে নাজেহাল করে তাঁকে।
কংগ্রেস  সভা ডেকে “তিরস্কার প্রস্তাব” পাস করে গান্ধীর বিরুদ্ধে। চরমপন্থী নথুরাম গডসে মুসলমান প্রীতিকে বিশ্বাসঘাতকতামূলক মনে করে গান্ধীকে হত্যা করে। কিন্তু গান্ধীজীই তো ভারতের জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনিরা জাতীয় মুক্তির কথা বলে। কিন্তু জাতির পিতার আসনেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু।
রাজনীতিকরা ফেরেস্তা নন। রাজনীতি বা রাজতন্ত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত ধর্মগ্রন্থ নয়। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কটুক্তি নতুন নয়। একে কেন্দ্র করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কতিপয় ধারা ব্যবহার হচ্ছে কটুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে। কারা নিপীড়নের শিকার কেউ কেউ।  প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে সরকারি দল এটাকে হাতিয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
 ‘রাজ’ শব্দটির সঙ্গে ‘নীতি’র সংযুক্তি অধুনালুপ্ত রাজতন্ত্রেরই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার ধারণ করছে।
রাজতন্ত্রের স্থলে গণতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয়েছে। রাজা নেই কিন্তু প্রজা আছে। দেশের পূর্ণাঙ্গ নামটিতে ‘প্রজা’ শব্দটি আরোপিত।
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” অর্থাৎ প্রজার তন্ত্রেই দেশ। সঙ্গে ‘গণ’ শব্দটির সংযোগে দাঁড়িয়েছে গণ+প্রজা+তন্ত্র = বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিকও জনগণ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও দেয়া আছে সংবিধানে। পদ-পদবীতে পরিবর্তন ঘটেছে। রাজা-বাদশা, সুলতান-নবাব-সুবেদার, উজীর-নাজির, লাট-বড়লাট,ভাইসরয়, গভর্নর-গভর্নর জেনারেল বলে কিছু নেই।
পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রপতিকে গভর্নর জেনারেল বলা হতো। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর জেনারেল পদটিকে রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট করেন। মোঘল আমলে প্রধানমন্ত্রীকে উজীরে আজম, মন্ত্রীদের উজীরে আলা বলা হতো।
যাহোক, অতীতের কিছু কটুক্তি তুলে ধরছি। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর থাকাকালে মালিক ফিরোজ খান নুন বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার খাঁটি মুসলমান নেই, ওরা খাৎনা করায় না, ছেলেমেয়ে জন্মালে বামুন বাড়ি নিয়ে যায় নাম রাখার জন্য।”
পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় তখন এক সম্পাদকীয়তে লেখা  হয় যে,খাৎনা করানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজাম “আমদানী” করা হোক। খ্যাতিমান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী এক উপভোগ্য মন্তব্য করে লিখেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানি ছেলেদের খাৎনা করা হয় না- এ কথাটি নাকি স্ত্রী ভিকারুননিসা নূন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে স্বামী মালিক ফিরোজ খান নুনকে জানিয়েছেন।”
এরকম বক্তব্যও হজম করেছিলেন ফিরোজ খান নুন। তাঁর স্ত্রী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঢাকার স্বনামধন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুলটি।
আওয়ামী লীগ প্রধান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে এই ফিরোজ খান নুন তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীও হন।
১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস। ওদিন প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে “ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুত্তা ও দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অথচ সোহরাওয়ার্দীই ছিলেন পাকিস্তান প্রস্তাবক। ভাসানীকে কারারুদ্ধ করে বলে
বিরুদ্ধাচারণ করবে তাদের মাথা ভেঙে ফেলবো-‘সের কুচল দেঙ্গে।’
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলাকে পদচ্যুত করে দেশদ্রোহী বলেন। জিন্নাহর নির্দেশেই মুসলিম লীগ  শেরেবাংলার “লাহোর প্রস্তাব” সংশোধন করে সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে “পাকিস্তান প্রস্তাব” পাস করে দিল্লি কনভেনশনে।
পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেছিলেন, ‘মওলানা ভাসানী দেশে ফিরলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে।’
জেনারেল আইউব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কি ধরনের কটুক্তি করেছেন তা-তো ইতিহাসে চোখ রাখলেই দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানিদেরই শুধু নয়, এদেশীয় দালাল রাজাকারদের চোখেও ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রদোহী, ইসলামের শত্রু। কিন্তু তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন আর স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়েছেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীদের কাছ থেকে অনেক কটুক্তি শুনেছেন। ডাকসু ভবন থেকে তাঁর ছবি অপসারণ, আজীবন সদস্য পদ কেড়ে নেয়া, সনদে অগ্নিসংযোগ এসবই ঘটে তাঁর জীবদ্দশায়। ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক “জাতির পিতা”  “বঙ্গবন্ধু” উপাধি ব্যবহার করা হবে না এমন ঘোষণাও তাঁকে শুনতে হয়।
ন্যাপনেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, “বঙ্গবন্ধুর গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানো হবে।”
এমন ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের পরেও শেখ মুজিব অবলীলায় তা হজম করেছিলেন। সেই মতিয়া চৌধুরী ‘৮৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগে। মতিয়া চৌধুরী শেখ হাসিনার মন্ত্রীত্ব করেছেন।
জাসদ অস্ত্রের মুখে সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে ন্যাক্কারজনক কতই না উক্তি করেছিল। আবার জাসদ নেতা আসম রব, হাসানুল ইনু শেখ হাসিনারই মন্ত্রীত্ব করেছেন।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ফেসবুকে লাইক দিন